পালং শাক খাওয়ার নিয়ম-পালং শাক খাওয়ার উপকারিতা সম্পর্কে জানুন।
পালং শাক খাওয়ার সঠিক নিয়ম এবং পালং শাক খাওয়ার উপকারিতা সম্পর্কে কম বেশি আমাদের সকলেরই কিছু না কিছু ধারণা রয়েছে। আমাদের দেশে প্রাচীনকাল থেকে পালং শাক খাওয়া হয়ে আসছে। পালং শাকের মধ্যে রয়েছে নানাবিধ গুনাবলি এবং বিভিন্ন রোগ সারাতে সাহায্য করে। পালং শাকের সবচেয়ে বড় গুণ হলো শরীরের ভেতরের অর্থাৎ কিডনির পাথর গলিয়ে বের করে দিতে সাহয্য করে।
এছাড়া পালং শাক গর্ভবতী মহিলাদের জন্য কেমন উপকারী, সুস্থ্য থাকতে পালং শাকের ভূমিকা কতটুকু, পালং শাক কতটা রোগের শেফা হিসেবে কাজ করে থাকে, পালং শাক খেলে কত মারাত্বক রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে তা এই পোষ্টটি পড়ে আপনি জানতে পারবেন। লেখাটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ার অনুরোধ রইলো।
ভূমিকা
আমাদের অনেকের রোজাকার খাবারের তালিকায় পালং শাক বিদ্যমান থাকে। পালং শাকের সংস্কৃত ভাষায় অনেক শ্রুতি মধুর নাম রয়েছে--সুপত্র, স্নিগ্ধপত্রা, দুরিতা, চিরিতচ্ছদা। পালং শাকের গুনাবলি, পালং শাক খাওয়ার সঠিক নিয়ম, পালং শাক খাওয়ার উপযুক্ত সময়, পালং শাক খাওয়ার বিভিন্ন উপকারিতা, বিভিন্ন কার্যকারিতা সম্পর্কে আমাদের সম্যক ধারণা রাখা জরুরী।
কেননা যেকোন জিনিস সম্পর্কে ধারণা থাকলে সেই জিনিসের প্রতি আগ্রহটা আরও বেশি বেড়ে যায়। আপনি যদি পালং শাক খাওয়ার উপকারিতা না জানেন তাহলে পালং শাক খাওয়ার প্রতি আপনার আগ্রহ তেমন বাড়বে না। পালং শাকে কি কি ভিটামিন রয়েছে তা আপনি জানতে পারবেন।
পালং শাক খাওয়ার উত্তম নিয়ম
যেকোন জিনিসের কিছু নিয়ম-নীতি রয়েছে। নিয়ম অনুসারে খাইলে বা কাজ করলে তার পরিপূর্ণ গুনাগুন পরিলক্ষিত হয়। পালং শাক খাওয়ার সঠিক নিয়ম বা ব্যবহার সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলোঃ
- পালং শাক ভাজার সময় পানি দেয়া যাবেনা। পালং শাকের পানিতেই যেন তা সেদ্ধ হয়ে যায়। প্রয়োজন হলে বা সেদ্ধ না হলে খুব অল্প পরিমাণে পানি দেয়া যাবে। রান্নার পর যেন বাড়তি পানি ফেলে দেয়া না লাগে। কেননা পানি ফেলে দিলে সেই পানির সাথেই শাকের পোষকতত্ত্ব বা উপকারিতা গুলো বেরিয়ে যাবে।
- পাঁচমেশালী তরকারীর সাথে মিশিয়ে পালং শাক , শিম, পালঙের চচ্চড়ি (পালং শাকের ডাঁটা ও নরম বীজসহ) খেলে পালং শাকের উপকারিতা তো পাবেই। সেইসাথে অন্য তরকারীর গুনাগুন ও ভিটামিনও যুক্ত হবে।
- ডালের প্রোটিনে সাধারণত এমিনো এসিড নাই। কিন্ত পালং শাকে এমিনো এসিড রয়েছে। কাজেই ডাল এবং পালং শাক মিশিয়ে রান্না করে খেলে তা শরীরের পক্ষে বেশ উপকারী।
- টক পালং শাককে সংস্কৃত ভাষায় বলা হয় চুক্রিকা বা চুক্রক। এই পালং শাক দেখতে সাধারণ পালং শাকের মতোই। কিন্ত টক অস্বাদযুক্ত বা খেতে টক লাগে। এই শাক বাত, কফ ও পিত্ত নাশ করতে সাহায্য করে থাকে। খাবার সহজে হজম হয়ে থাকে, খাওয়ার রুচিও বাড়ে। বায়ুজনিত অস্বস্তি দূর করতে সাহায্য করে, বিষ নাশ করে থাকে এবং মল রোধ করতে সাহায্য করে।
- চিনির রস মিশিয়ে খেলে পিত্তের আধিক্য সারানোর পক্ষে বেশ উপকারী। দাঁতের ব্যাথা দূর করতে ব্যাপক কাজ করে থাকে। বমি বমি ভাব বন্ধ করে দেয় এবং খিদে বাড়াতে সাহায্য করে। চুকো পালং এর রসের প্রলেপ লাগালে বিছের কামড়ের বিষ দূর হয়ে যায় এবং ব্যাথাও সেরে যায়। রস হালকা গরম করে সেই রস কানে লাগালে কানের ব্যাথা দূর হয়ে যায়। টক পালং এর বীজ ঘিয়ে ভেজে খেলে আমাশার উপশম হয়।
পালং শাক খাওয়ার উপকারিতা
গুনগত দিক থেকে দেখতে গেলে পালং শাক ভাজা, পালং শাকের চচ্চড়ি অন্যান্য অনেক তরকারীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। পালং শাকের বিভিন্ন উপকারিতা সম্পর্কে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলোঃ
- পালং শাক প্রশ্বাসের কষ্ট দূর করতে সাহায্য করে থাকে। পিত্তের পক্ষে অনেক উপকারী এবং কফের কষ্ট দূর করতেও ব্যাপক কার্যকরী।
- পালং শাক রুচি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে এবং খাবার তাড়াতাড়ি হজম করতেও সাহয্য করে থাকে। এমনকি প্রস্রাবের মাত্রা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
- শরীরের অন্ত্রগুলো সচল রাখতে সাহায্য করে এবং অন্ত্রের ভিতরে জমে থাকা মল বের করে দিতেও ব্যাপক সাহায্য করে থাকে।
- ডায়াবেটিস রগীদের পালং শাক অনেক উপকারী খাদ্য হিসেবে বিবেচিত।
- পালং শাকের বীজও মল নিষ্কাশনে সাহয্য করে থাকে, শরীর ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে, লিভারের অসুখ, জন্ডিস ও পিত্তের রোগ উপশম করতে সাহায্য করে।
- পালং শাকের বীজের ঘন তেল কৃমি এবং মূত্রের রোগে বেশ উপকারী।
- পালং শাকের রস গলা, ফুস্ফুস, শ্বাসনালিকার কষ্ট ও শরীর জ্বালা পোড়া করলে খাওয়ানো হয়।
- পালং শাকের রস খেলে কিডনির পাথর গলে গিয়ে প্রস্রাবের সাথে বেরিয়ে যেতে সাহায্য করে।
- পালং এর পাতা পিষে নিয়ে পুলটিস তৈরী করে বাঁধলে কাঁচা ফোঁড়া পেকে যেতে সাহায্য করে। এই ফোঁড়ার জন্য যদি গায়ে জ্বর আসে তাও ভালো করতে সাহায্য করে।
পালং শাকে কি কি ভিটামিন থাকে
পালং শাকে যে পরিমাণ গুনাগুন এবং কার্যকারীতা রয়েছে অবশ্যই এই শাকে বেশ কিছু ভিটামিনও বিদ্যমান রয়েছে। বৈজ্ঞানিকদের মতে, পালং শাকে বেশ কয়েকটি ভিটামিন উপস্থিত রয়েছে। যেগুলো সম্পর্কে আমরা কিন্ত অনেকেই জানিনা। সেগুলো হলো-ভিটামিন 'এ', ভিটামিন 'বি', ভিটামিন ''সি', ও ভিটামিন 'ই' বিদ্যমান রয়েছে।
এছাড়া প্রোটিন, সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ক্লোরিন আর লোহা রয়েছে। পালং শাক শরীরে ব্যাপক শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে থাকে। পালং শাকে প্রোটিন উৎপাদক এমিনো এসিড বেশি পরিমাণে রয়েছে। এর সবুজ পাতায় এমন কিছু গুন রয়েছে যে, খেলে আপনার শরীরের বৃদ্ধি এবং বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে।
এমনকি বুদ্ধি এবং মেধা শক্তি বাড়াতেও বেশ কার্যকরী। আমরা নিয়মিত যে ডাল খেয়ে থাকি তার প্রোটিনের মধ্যে কিন্ত এমিনো এসিড নেই। সেজন্য ডালের ভিতর পালং শাক দিয়ে রান্না করে খেলে তার অভাব পূরণ করতে সাহয্য করবে।
গর্ভাবস্থায় পালং শাক খেলে কি হয়
গর্ভাবস্থায় সবকিছুরই নিয়ম মাফিক করে চলতে হবে। এই সময়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আবার বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। গর্ভাবস্থায় খাবার-দাবার, চলাফেরা, নিয়ম অনুসারে গুমানো, হাঁটা-হাঁটি করা, ফলমূল, শাক-সবজি ইত্যাদি পরিমাণ মতো এবং প্রয়োজন অনুসারে খাওয়াতে হবে। শাক-সবজির মধ্যে অন্যতম হলো পালং শাক খাওয়া।
কেননা পালং শাকের মধ্যে যে ভিটামিন, আয়রন, ক্যালসিয়াম রয়েছে তা বাচ্চার মা এবং আগত বাচ্চার জন্য বেশ উপকারী। কেননা এই সময়ে যা কিছু খেতে হবে তা অবশ্যই মা এবং শিশুর জন্য পুষ্টিকর এবং স্বাস্থ্যসম্মত হতে হবে। গর্ভাবস্থায় পালং শাক খাওয়ার কতিপয় কিছু গুনাগুন নিম্নে আলোচনা করা হলোঃ
- গর্ভাবস্থায় পালং শাক খাওয়ার ফলে আগত শিশুর জ্ঞানীয় বিকাশ লাভ করতে সহায়তা করবে।
- এই সময়ে পালং শাক খাওয়ার ফলে বাচ্চার মেজাজ ভালো রাখতে সাহয্য করবে।
- পালং শাক খাওয়ার ফলে বাচ্চার হাড়গুলো মজবুত করতে সাহায্য করবে।
- পালং শাক খাওয়ার ফলে বাচ্চার দাঁত গুলো স্বাস্থ্যকর রাখতে সাহায্য করবে।
- পালং শাক খাওয়ার ফলে বাচ্চার কোলেস্টোরেলের মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করবে।
- গর্ভাবস্থায় পালং শাক খাওয়ার ফলে বাচ্চার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করবে।
- রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক চলাচল রাখতে সাহায্য করবে।
- গর্ভাবস্থায় পালং শাক খেলে বাচ্চার দৃষ্টি শক্তি ভালো রাখতে সাহায্য করবে।
- এমনকি বাচ্চার ত্বক উজ্জ্বল করতেও সাহায্য করবে।
রোগ সারাতে পালং শাকের ভূমিকা
পালং শাক অনেক পুষ্টিকর এবং সহজলভ্য সবজি হিসেবে আমাদের সবার কাছেই প্রায় পরিচিত। পালং শাকের গুনাগুন, পালং শাক খাওয়ার উত্তম নিয়ম, পালং শাকে অনেক ভিটামিন বিদ্যমান রয়েছে। এসব কিছুর পরেও পালং শাক খেলে যে বিভিন্ন রোগ নিরাময় হয় বা বিভিন্ন রোগের ঔষধ হিসেবে কাজ করে থাকে তা আমরা অনেকেই জানিনা।
গুনাগুন, খাওয়ার নিয়ম এবং কার্যকারীতার পর পালং শাক খেলে যেসব রোগ সারাতে সাহায্য করবে তা জেনে নিই।
- অনেকদিনের অসুখে বা অনেক দিনের রোগে ভোগার পর পালং শাক খেতে দেওয়া হয়। কেননা পালং শাক খেলে রুচি বাড়ে, শরীরে শক্তি বৃদ্ধি হয়, শরীরের স্বাভাবিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
- পালং শাকের শেকড় ঘিয়ে ভেজে খেলে রাতকানা রোগ থেকে রেহাই পাওয়া যায়।
- পোড়া ঘায়ে, ক্ষতস্থানে, ব্রণেতে বা কালশিরা পড়লে টাটকা পালং পাতার রসের প্রলেপ লাগালে খুবই উপকার পাওয়া যায়।
- পালং এর বীজ শরীরে ঘাম সৃষ্টি করে, স্নিগ্ধতা বাড়ায়, পেটের অসুখ, একটানা পুরনো পেটের অসুখে দারূণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
- পালং শাক রক্ত পরিষ্কার করতে সাহায্য করে, রক্ত বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে, চোখের জ্যোতি বাড়াতে সাহায্য করে, এমনকি মুখের লাবণ্য বাড়িয়ে দিতে সাহায্য করে থাকে।
শেষ কথা ও লেখকের মন্তব্য
উপোরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা নিশ্চয়ই জানতে পারলাম পালং শাক খাওয়ার সঠিক নিয়ম, পালং শাক খাওয়ার কতিপয় উপকারিতা, পালং শাক খাওয়ার কার্যকারীতা, পালং শাক কি কি রোগ নিরাময় করতে পারে, গর্ভাবস্থায় পালং শাক খাওয়া কেমন উপকারী ইত্যাদি বিষয়ে আমরা জ্ঞানার্জন করতে সক্ষম হলাম। পালং শাক কিন্ত জন্ডিস রোগীদের জন্য উপকারী।
পালং শাক খেলে শরীরে রক্ত বাড়ানোর গুন অনেক বেশি রয়েছে। পালং শাক খেলে যে শুধু রক্ত বৃদ্ধি হয় তা কিন্ত নয়, পালং শাক খেলে রক্ত শুদ্ধি করতেও সাহায্য করে। পালং শাকের সবুজ পাতা হলো জীবনীশক্তির মুল। ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে বাচ্চাদের বেশি করে টাটকা পালং শাকের রস খাওয়ানো যেতে পারে, তার সাথে অবশ্য দুধও খাওয়াতে হবে।
লেখাটি সম্পূর্ণ পড়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আজকের এই লেখাটি পড়ে যদি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই অন্য কারো সাথে শেয়ার করবেন। আর যদি আপনার কোন মতামত বা পরামর্শ থেকে থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন, ধন্যবাদ।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url